অর্থ-বাণিজ্য

একের পর এক এমডির পদত্যাগ

ব্যাংক খাতে অস্বস্তি বাড়ছে

মিডিয়া এক্সপ্রেস ডেস্ক
প্রকাশিত : সোমবার, ২০২৩ সেপ্টেম্বর ১১, ০১:২১ অপরাহ্ন
#

ডলার সংকটের মধ্যে ব্যাংক খাতে চলছে টাকার টানাটানি। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে অনেক ব্যাংক নিয়মিত ধার করছে। এর পরও কিছু ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারছে না। এই সংকটের মূলে রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আস্থাহীনতা ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত অনুযায়ী খেলাপি ঋণ কমানো ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিয়ে চাপে রয়েছে ব্যাংক খাত। এমন সময়ে একের পর এক পদত্যাগ করছেন বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। এ নিয়ে ব্যাংক খাতে তৈরি হয়েছে নতুন অস্বস্তি। খবর সমকাল

মালিকানা বদল বা পরিচালকদের চাপে পড়ে ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে কয়েকটি ব্যাংকের এমডি পদত্যাগে বাধ্য হন। করোনা শুরুর পর ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত শিথিলতা। তখন এমডিদের ওপর তেমন চাপ ছিল না বলে মনে করা হয়। ওই তিন বছরে পদত্যাগ করেন একজন এমডি। তবে চলতি বছর যেন এমডিদের পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে।


গত ১৬ জানুয়ারি ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্তৃত্বে থাকা ‘সিকদার পরিবার’-এর চাপে পদত্যাগ করেন ব্যাংকটির এমডি মেহমুদ হোসেন। এর পর গত জুলাইয়ে পদত্যাগ করেন ব্যাংক এশিয়ার এমডি আরিফ বিল্লাহ আদিল চৌধুরী। গত সপ্তাহে পদত্যাগ করেন পদ্মা ব্যাংকের এমডি তারেক রিয়াজ খান এবং সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের এমডি হাবিবুর রহমান। এত কম সময়ে চার এমডির পদত্যাগ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। এসব এমডি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করলেও পরিচালকদের চাপেই তারা পদ ছাড়তে বাধ্য হন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, ‘সাধারণত পরিচালকদের সঙ্গে এমডিরা তাল মিলিয়ে চলেন। পরিচালকদের কথা শুনতে শুনতে এক সময় সব সয়ে যায়। এক পর্যায়ে যখন তারা আর পেরে ওঠেন না অথবা দুদক ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পদত্যাগ করে ফেলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটে। আবার কেউ কেউ যখন দেখেন, নিজের মতো কাজ করতে পারছেন না, তখন সম্মান নিয়ে সরে যান।’

ড. সালেহউদ্দিন জানান, তিনি গভর্নর থাকাকালেও অনেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। তখন তাদের বলেছিলেন খারাপ সময় পার হলে পদত্যাগ করতে। তিনি বলেন, ‘চাইলেই কাউকে পদত্যাগ করতে দেওয়া ঠিক না। কেন পদত্যাগ করতে চান, কোনো পক্ষের চাপ আছে কিনা– কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসব ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত। তা না হলে আমানতকারীসহ সবার কাছে খারাপ বার্তা যায়।’

কয়েকজন সিনিয়র ব্যাংকার জানান, গত আগস্টে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষের হাতের টাকা ব্যাংকে ফেরানোর তাগিদ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে একের পর এক এমডির পদত্যাগের ঘটনা আমানতকারী, বিনিয়োগকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের খারাপ বার্তা দিচ্ছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত পদত্যাগের প্রকৃত কারণ বের করে পরিচালকদের কঠোর বার্তা দেওয়া। অনিয়ম, জালিয়াতির বিরুদ্ধে শিথিলতা থেকে সরে এসে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। কেননা, উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে মানুষের ভেতর বেশি লাভের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের প্রবণতা বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা শুরুর পর ব্যাংক খাতে অনেক শিথিলতা ছিল। ওই সময় ঋণ আদায় না হলেও খেলাপি দেখাতে হয়নি। আবার চাহিদা থাকুক বা না থাকুক; প্রণোদনার আওতায় কম সুদে ঋণ বিতরণে ব্যাংকারদের ওপর চাপ ছিল। ফলে যাচাই-বাছাই ছাড়া তখন অনেক ঋণ দেওয়া হয়েছে। নীতি-শিথিলতার পাশাপাশি ওই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রায় বন্ধ ছিল। ফলে জাল-জালিয়াতি হলেও তা ছিল আড়ালে। তবে

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তে যেন সব হিসাব বদলে গেছে। নতুন কোনো শিথিলতা দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ আদায় জোরদারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ ধীরে ধীরে কমিয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকে ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামাতে বলা হয়েছে। আমানত বাড়ানো, সুশাসন জোরদার, যাকে ইচ্ছা ঋণ প্রদান বন্ধ করতে বলা হয়েছে। আবার ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে আলাদাভাবে তদারকি করা হচ্ছে।

আর্থিক খাত বিশ্লেষক ও বেসরকারি ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি ফারুক মঈনউদ্দীন সমকালকে বলেন, ‘যেসব এমডি পদত্যাগ করেছেন, তারা বেসরকারি ব্যাংকের। প্রত্যেকে ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগের কথা বললেও প্রকৃত কারণ অজানা। তারা কেন পদত্যাগ করেছেন, ভেতরে না ঢুকলে বলা যাবে না। তবে এটা বলা যায়, এভাবে একের পর এক এমডির পদত্যাগ স্বাভাবিক নয়।’ তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সুরক্ষা নীতিমালা আছে। কিন্তু পদত্যাগকারী এমডিরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছেও প্রকৃত ঘটনা বলছেন না।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ ঋণ স্থিতি কমে হয়েছে ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। আগের মাস জুন শেষে তা ছিল ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। এর মানে, এক মাসের ব্যবধানে ঋণ স্থিতি কমেছে ৮ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। অবশ্য আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। গত জুলাইয়ে এ প্রবৃদ্ধি ২১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণও ধারাবাহিকভাবে কমে গত জুলাই শেষে হয়েছে ১ হাজার ৩৩৮ কোটি ডলার, যা গত বছরের জুন শেষে ছিল ১ হাজার ৭৭৬ কোটি ডলার।

কেন এত পদত্যাগ

আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক পরিচালকদের বিভিন্ন লক্ষ্য দিয়ে কেউ কেউ এমডি হন। আবার অনেক সময় এমডিকে পরিচালকদের স্বার্থ দেখতে হয়। এতে অনেক সময় এমডি ব্যর্থ হন। ফলে পরিচালকদের সঙ্গে এমডির দূরত্ব তৈরি হয়। ওই পরিচালকরা ব্যাংকের পর্ষদ সভাসহ বিভিন্ন সভায় এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন, যাতে এমডি পদত্যাগে বাধ্য হন। অনেক সময় আকার-ইঙ্গিতে কিংবা সরাসরি এমডিকে পদত্যাগ করতেও বলা হয়। তবে এসবের কোনো প্রমাণ বা রেকর্ড থাকে না।

মেহমুদ হোসেন ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। ব্যাংকটির একটি সূত্র জানায়, পদত্যাগের দু’দিন আগে তাঁকে বনানীর সিকদার হাউসে ডেকে নেন ব্যাংকটির কর্তৃত্বে থাকা সিকদার পরিবারের লোকজন। সেখান থেকে ফেরার দু’দিন পর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন। তাঁর পদত্যাগ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশের পর ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, খেলাপি ঋণ আদায়-সংক্রান্ত এক বৈঠকে যোগ দিয়ে পরিচালকদের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এক বছর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ব্যাংকের কোনো সফলতা তিনি আনতে পারেননি। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় আবার ন্যাশনাল ব্যাংকে এমডি পদে যোগ দেন মেহমুদ হোসেন।

দেশের ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ব্যাংক এশিয়া। গত বছরের আগস্টে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রোমো রউফ চৌধুরী। এর পর তিন বছরের জন্য গত বছরের নভেম্বরে ব্যাংকটির এমডি হিসেবে নিয়োগ পান আরিফ বিল্লাহ আদিল চৌধুরী। তবে আট মাস না পেরুতেই গত ২৬ জুলাই পদত্যাগ করেন তিনি। আগামী ২১ অক্টোবর পর্যন্ত তাঁর ছুটি হিসেবে গণ্য হবে। এর পর থেকে পদত্যাগ কার্যকর।

গত ৩ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন বিভিন্ন জালিয়াতির কারণে আলোচিত ফারমার্স থেকে রূপান্তরিত পদ্মা ব্যাংকের এমডি তারেক রিয়াজ খান। ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত তাঁর মেয়াদ ছিল। দেড় বছরের বেশি মেয়াদ থাকতেই পদত্যাগ করলেন তিনি। ২০১৩ সালে ফারমার্স নামে যাত্রার সময় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। বর্তমান চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করেন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের এমডি হাবিবুর রহমান। গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকটিতে যোগ দেন তিনি। তাঁর মেয়াদ ছিল ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। গত আগস্টে ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এ জেড এম শফিউদ্দিন শামীম। আগের চেয়ারম্যান থার্মেক্স গ্রুপের কর্ণধার আব্দুল কাদির মোল্লার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিনি চেয়ারম্যান হন। জানা গেছে, আব্দুল কাদির মোল্লা মনে করেন, তাঁর চেয়ারম্যান পদ হারানোর পেছনে হাবিবুর রহমানের ভূমিকা ছিল। এসব নিয়ে মনোমালিন্যের মধ্যেই গত ৩ সেপ্টেম্বরের পর্ষদ সভায় এমডিকে ‘একহাত নেন’ তিন পরিচালক। এর পর ৭ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন হাবিবুর রহমান।

কাজে আসছে না সুরক্ষা নীতিমালা

২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমডিদের হুটহাট পদত্যাগে বাধ্য করা বা চাকরিচ্যুতি ঠেকাতে একটি সুরক্ষা নীতিমালা করে। ওই নীতিমালা করার পেছনের কারণ ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। ওই সময় ব্যাংকটিতে কোনো এমডি টিকতে পারছিলেন না। এমন প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়, কেউ ব্যাংকের এমডির চাকরি ছাড়তে চাইলে এক মাস আগে নোটিশ দিতে হবে। আবার পর্ষদ কাউকে বাদ দিতে চাইলেও এক মাস আগে জানাতে হবে। উভয় ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য হবে। তবে এই সুরক্ষা নীতিমালা কোনো কাজে আসছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, পরিচালকরা ইচ্ছামতো আইন সংশোধন করাতে পারছেন। অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামত উপেক্ষা করে তাদের চাওয়া প্রধান্য পাচ্ছে। সর্বশেষ চলতি বছর সংশোধনীতে ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিচালকদের মেয়াদ বাড়িয়ে ১২ বছর এবং কোনো গ্রুপ বা ব্যক্তির মালিকানাধীন এক কোম্পানি খেলাপি হলেও আরেক কোম্পানির নতুন ঋণের সুযোগের বিষয়টি সংযোজন করা হয় পরিচালকদের চাওয়ার প্রেক্ষাপটে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে পাশ কাটিয়ে এভাবে আইন সংশোধন বা যখন যে সুবিধা দরকার তারা তা পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে এমডিদের ওপর চাপ তৈরিতে তারা কোনো সমস্যা দেখছেন না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘নিজের বিবেকের দায় মেটাতে চাইলে এখন ব্যাংকের এমডি পদে কাজ করা অনেক কঠিন। কেননা, পরিচালকরা এখন ব্যাংক পরিচালনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করছেন। তাই এভাবে পদত্যাগ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়, বরং দিন দিন এটা বাড়বে।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও বেশি কিছু করতে পারবে না। কেননা, ব্যাংকের পরিচালকরা অনেক বেশি প্রভাবশালী।’

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

আরও খবর

Video