উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা (এমপি) স্কুল বা কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হতে পারবেন না। সারা দেশে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলেও ব্যতিক্রম রাজধানীর মতিঝিল থানার গোড়ান আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। এমপিওভুক্ত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে টানা পাঁচ মেয়াদ ধরে বহাল আছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নার্গিস রহমান। বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে সম্প্রতি মামলা হয়েছে। অবাক করা বিষয় হলো, বিদ্যালয়ের ফান্ড থেকেই জোগান দেওয়া হচ্ছে এই মামলার যাবতীয় খরচ। অথচ এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ২৩ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। খবর- কালবলো
জানা গেছে, বিদ্যালয়ের সভাপতি পদে থাকার জন্য এমপি পরিচয় লুকিয়েছেন নার্গিস রহমান। তাকে সভাপতি মনোনীত করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাঠানো কাগজপত্রে নাম লেখা হয়েছে ‘নার্গিস রহমান’। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর বোর্ডের অনুমোদন সংক্রান্ত আদেশেও নামের পাশে এমপি লেখা হয়নি। অথচ এই নার্গিস রহমান সংরক্ষিত মহিলা আসন-২৫-এর সংসদ সদস্য। ২০০৮ সাল থেকে তিনি এই বিদ্যালয়ের সভাপতি পদে আছেন। বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কোথাও তার এমপি পরিচয় ব্যবহার করেন না তিনি। পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির সিলেও নামের পাশে ‘এমপি’ লেখা নেই। স্কুলের কোনো কাজে কেউ যাতে এ পরিচয় ব্যবহার না করে, সে বিষয়েও কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন এমপি নার্গিস রহমান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একজন সংসদ সদস্য আগে সর্বোচ্চ চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে থাকতে পারতেন। কিন্তু ২০১৬ সালের জুন মাসে উচ্চ আদালত এক আদেশে বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা
২০০৯-এর ৫ ধারা অবৈধ বলে রায় দেন। হাইকোর্টের এই রায়ের বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অনেকেরই অজানা ছিল। তবে সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর নার্গিস রহমানের সভাপতি পদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত ৩০ আগস্ট হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন গোড়ান আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির একজন সদস্য।
রিটকারীর আইনজীবী ড. ইউনুছ আলী আকন্দ বলেন, ‘আদালতের রায় স্পষ্ট যে, এমপিরা কোনো স্কুল বা কলেজের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডিতে থাকতে পারবেন না। এ রায়ের ফলে কোনো এমপিরই কমিটিতে থাকার সুযোগ নেই।’
সংশ্লিষ্ট একাধিক নথি থেকে জানা গেছে, রিট পিটিশন দায়েরের পর আদালত গোড়ান আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির কার্যক্রম ৩ মাসের জন্য স্থগিত করেন। গত ২০ সেপ্টেম্বর নার্গিস রহমান চেম্বার জজ আদালতে একটি ভ্যাকেট পিটিশন দাখিল করেন। তবে সেটি আমলে না নিয়ে চেম্বার জজ আদালত ‘স্ট্যাটাস কো’ বা স্থিতিশীল অবস্থায় থাকার আদেশ দেন। এর মানে হলো, বিদ্যালয়ের সভাপতির কার্যক্রম স্থিতিশীল থাকবে, তিনি নিয়োগ বা অন্য কোনো কাজ আপাতত করতে পারবেন না। আগামী ২০ নভেম্বর এ বিষয়ে চূড়ান্ত শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
অবাক করা বিষয় হলো, সভাপতি পদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের হওয়া রিটটি নার্গিস রহমানের বিরুদ্ধে হলেও মামলার কাজে তিনি কোনো টাকা খরচ করেন না। এ মামলার সব খরচ যাচ্ছে বিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে। গত ১২ সেপ্টেম্বর একটি সভা করে নার্গিস রহমানের পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নেয় বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি। ১৫ সেপ্টেম্বর সভাপতির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ম্যানেজিং কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি আহাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে শিক্ষক-কর্মচারীদের এক সভায় নার্গিস রহমানকে সভাপতি পদে পুনর্বহালের দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে সভাপতির মামলা পরিচালনার জন্য বিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে সব খরচ বহন করা হবে বলেও কাগজে-কলমে সিদ্ধান্ত হয়। মামলা প্রত্যাহারে যা প্রয়োজন তা করা হবে বলেও
শিক্ষক-কর্মচারীরা মত দেন।
জানা গেছে, বিদ্যালয়ের ফান্ডে সম্প্রতি ১ লাখ টাকা অনুদান দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। সেই টাকার পুরোটাই নার্গিস রহমানের মামলার পেছনে ব্যয় হয়েছে। গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত স্কুলের ফান্ড থেকে মোট ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। এর মধ্যে আইনজীবীর খরচ দেড় লাখ আর সত্যায়িত কপি, মামলার নথি উত্তোলন ও অফিস খরচ বাবদ ২৫ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সভাপতির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ম্যানেজিং কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি আহাদুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে এমন কোনো এমপি আছে, যিনি দু-চারটা স্কুলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই? তিনি (নার্গিস রহমান) এই বিদ্যালয়ের সভাপতি। সভাপতি ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা চেয়েছেন বলেই রেজুলেশন করা হয়েছে।’
বিদ্যালয়ের টাকায় নিজের মামলা কেন পরিচালনা করছেন, জানতে চাইলে গোড়ান আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নার্গিস রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘ম্যানেজিং কমিটির সবাই বসে এটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এটি বিদ্যালয়ের টাকা নয়, স্থানীয় এমপি মামলা পরিচালনার জন্যই এ টাকা দিয়েছিলেন। আর আমরা যখন আবার সভা করব, তখন আসবেন, এ বিষয়ে বুঝিয়ে দেব।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নার্গিস রহমানের মামলা পরিচালনার জন্য নয়, বরং গোড়ান আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনার কাজে ব্যয় করার জন্য স্থানীয় এমপি এ টাকা দিয়েছেন। শুধু এই বিদ্যালয়ই নয়, আবেদন করার পর ঢাকা-৯ আসনের আওতায় থাকা অনেক বিদ্যালয়কেই অনুদানের টাকা দেওয়া হয়েছে এমপির পক্ষ থেকে।
জানা গেছে, এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রায় ২৩ মাস ধরে বেতন পান না। সবশেষ ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের বেতন পেয়েছেন তারা। শিক্ষকরা জানিয়েছেন, বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক এমপিওভুক্ত। তারা ২৩ মাস ধরে শুধুমাত্র সরকারি অংশের টাকা পান। তবে শিক্ষার্থীদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিষ্ঠানে যে টাকা আসে, সে টাকা থেকে শিক্ষকদের বেতন নিয়মিত দেওয়া হয় না। সেই টাকা জমে এখন ২৩ মাসের বকেয়া পড়েছে। অন্যদিকে ৫-৬ জন শিক্ষক আছেন অ্যাডহকে নিয়োগ পাওয়া। তারা শিক্ষার্থীদের বেতনের টাকার ওপরই নির্ভরশীল। তাদের অবস্থা বেশি শোচনীয়।
বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, প্রতি মাসে দেরি করে দিতে দিতে প্রায় ২৩ মাসের বেতন বকেয়া পড়েছে। এ নিয়ে গভর্নিং বডির উদ্যোগ নেই।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সভাপতির দায়িত্ব পালনে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা অমান্য করেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেন নার্গিস রহমান। গত ২৫ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এতে আবেদনের জন্য সময় দেওয়া হয় মাত্র ১৫ দিন। গত ৪ অক্টোবর নার্গিস রহমানের সভাপতিত্বে ম্যানেজিং কমিটির এক সভায় প্রধান শিক্ষক নিয়োগে সাত সদস্যের পরীক্ষা কমিটিও গঠন করা হয়।
এদিকে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে মামলার তথ্য না জানিয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগে গত ৮ অক্টোবর মহাপরিচালকের প্রতিনিধির চিঠি গ্রহণ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ অক্টোবর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মহাপরিচালকের প্রতিনিধির কার্যক্রম স্থগিত করেন।
ম্যানেজিং কমিটির একজন সদস্য জানান, ‘এমপিরা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হতে পারবেন না’ হাইকোর্টের এমন নির্দেশনা এবং চেম্বার জজ আদালতের স্থিতিশীল থাকার বিষয়টি আমলে নিয়ে এ মুহূর্তে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ না দিতে কয়েকজন অনুরোধ করলে তাদের চাকরি কেড়ে নেওয়ার ও জেলে পাঠানোর হুমকি দিয়েছেন নার্গিস রহমান।
প্রধান শিক্ষক নিয়োগে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালকের প্রতিনিধি মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শায়লা নাসরীন। তিনি বলেন, ‘নিয়োগের বিষয়ে আদালত স্থিতিশীল অবস্থা জারি করেছিলেন, তবে মামলার বিষয়ে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। ওই বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির কয়েকজন সদস্য সম্প্রতি আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাদের বলেছি, আইনগত মতামত ছাড়া আমি যাব না।’
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুল মজিদ বলেন, ‘আমরা নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো মামলা আছে কি না জানতে চেয়েছিলাম। মামলা নেই বলে জানিয়েছেন তারা। সে অনুযায়ী আমরা নিয়োগের বিষয়ে অফিস আদেশ জারি করি; কিন্তু পরবর্তী সময়ে মামলার বিষয়টি জানতে পেরে সেই অফিস আদেশ স্থগিত করি। এরপর পুরো বিষয়টি আমরা মাউশির আইন শাখায় পাঠিয়ে দিয়েছি।’
এমপি পরিচয় গোপন করে বিদ্যালয়ের সভাপতি পদে বহাল থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে নার্গিস রহমান কোনো সদুত্তর দেননি।