বিভিন্ন চ্যাটিং অ্যাপের মধ্যে টেলিগ্রামকে সবচেয়ে নিরাপদ ধরা হয়। কিন্তু সম্প্রতি টেলিগ্রামের প্রধান নির্বাহী পাভেল দুরভের গ্রেফতার এবং টেলিগ্রাম বিষয়ক উন্মোচিত নতুন তথ্যাদি গ্রাহকদের মনে প্রশ্ন জেগেছে। এতদিন যে টেলিগ্রামকে নিরাপদ ভেবে তারা স্পর্শকাতর তথ্য আদান-প্রদান করে এসেছেন সেটি কি আদৌ নিরাপদ?
হোয়াটসঅ্যাপ, আইম্যাসেজ বা সিগন্যালের মতো চ্যাটিং অ্যাপের সঙ্গে নানা দেশের সরকার প্রধানদের প্রায়ই বসা হয় নিরাপত্তার বিষয় ঘিরে। এসব টেক কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের দাবি গ্রাহকের কথপোকথন কিংবা তথ্য বা ছবি আদান-প্রদানের নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা সর্বাগ্রে। কোনো দেশের সরকার চাইলেই সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাঘা বাঘা গণতান্ত্রিক দেশ জনগণের বাকস্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে দেখে তাদের ভাষ্য, এমন অ্যাপের মাধ্যমে শুধু ব্যক্তিগত আলাপ হয় না। দিনকে দিন এসব অ্যাপের গোপনীয়তাকে পুঁজি করে ডিজিটাল দুনিয়ার এসব সেবাখাত হয়ে উঠেছে অপরাধীদের অভয়ারণ্য।
বেআইনি তথ্য আদান-প্রদান কিংবা বিনা অনুমতিতে তোলা ছবি বা ভিডিওর ছড়াছড়ি এসব অ্যাপে। গ্রাহকের নিরাপত্তার কথা বলে টেক মালিকরা সাইবার অপরাধীদের দেদারসে অপরাধের সুযোগ করে দিয়েছেন। এমন ধাঁচের একটি অভিযোগ তুলে ফ্রান্সের সরকার সম্প্রতি গ্রেফতার করেছেন টেলিগ্রামের প্রধান নির্বাহী দুরভকে।
ফ্রান্স কর্তৃপক্ষের ভাষ্য একটি শিশুর স্পর্শকাতর ছবি ছড়ানো প্রসঙ্গে টেলিগ্রাম চ্যানেলের গ্রাহক হিসেবে থাকা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের তথ্য জানতে পাভেল দুরভকে বেশ কয়েকবার তলব করা হয়। কিন্তু তিনি সরকারের এ ডাককে তোয়াক্কা করেননি। তাই তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে ৫ মিলিয়ন ডলার ইউরোর বিনিময়ে ছাড়া পেয়েছেন দুরভ। তবে এখন থেকে প্যারিসের আদালতে সপ্তাহে দুদিন করে হাজিরা দিতে হবে তাকে।
দুরভ কী গ্রাহকের বাকস্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন নাকি দুরভের বাকস্বাধীনতার বুলি স্রেফ ভাওতাবাজি- এ নিয়ে উঠেছে নানামুখী প্রশ্ন।
টেক বিশ্লেষকদের মতে, দুজন ব্যক্তির তথ্য আদান-প্রদান শতভাগ নিরাপদ রাখা সম্ভব ‘এন্ড টু এন্ড ইনক্রিপশন’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা সিগন্যালের মতো চ্যাটিং অ্যাপে এই প্রযুক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু থাকলেও টেলিগ্রামে এটি গ্রাহককে সেটিংস এ গিয়ে আলাদা করে চালু করতে হয়।
যে টেলিগ্রামকে দুরভ এতদিন সিক্রেট ম্যাসেজিং অ্যাপ বলে দাবি করে আসছেন সেটির চ্যাটিং সার্ভিস স্বয়ংক্রিয় না এবং চাইলে তৃতীয় পক্ষ সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন। বিশেষ করে টেলিগ্রামের কর্তাব্যক্তিরা চাইলেই দেখতে পারবেন যে কারো কথপোকথন বা তথ্য-ছবির আদান-প্রদান।
এন্ড টু এন্ড ইনক্রিপশনের সবচেয়ে বড় সুবিধা দুজনের কথোপকথন চাইলে যেই প্ল্যাটফর্মে কথা হচ্ছে তার কর্তাব্যক্তিরাই দেখতে পারবেন না। এমনকি হ্যাকার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করলে, কিছু হিজিবিজি ইনক্রিপটেড কোডিং ছাড়া অন্যকিছু খুঁজে পাবে না। সিক্রেট ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামে যেখানে ইনক্রিপশনের এই সুবিধা সর্বাগ্রে থাকার কথা, সেখানে ম্যানুয়ালি সিক্রেট চ্যাট অপশন চালু না করা অবধি গ্রাহক এই সুবিধা নিতে পারবেন না।
বর্তমানে ৩৯ বয়সী পাভেল দুরভ ২০১৩ সালে রাশিয়ায় টেলিগ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর আগে ২০০৬ সালে রাশিয়া থাকতেই ফেসবুকের মতো একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুরভ। নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলো দুরভকে রাশিয়ার মার্ক জাকারবার্গ বলে আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু রুশ সরকারের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান সংক্রান্ত স্বাধীনতা নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় অনেকটা বাধ্য হয়েই ২০১৪ সালে রাশিয়া ছাড়তে হয় তাকে।
২০১৫ সালে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দুরভ বলেছিলেন, ‘অনেক দেশের সরকার বলেন এ ধরনের প্রাইভেট চ্যাটে বেআইনি অনেক কিছু হয়। এজন্য তাদের কাছে গ্রাহকদের আলাপে প্রবেশাধিকার দিতে হবে।’
দুজনের কথোপকথনের মধ্যে তৃতীয় এক পক্ষ নজরদারি করছে এরচেয়ে বড় বেআইনি ব্যাপার আর কী হতে পারে- প্রশ্ন তোলেন দুরভ।
যেই দুরভ কি না বাকস্বাধীনতার প্রশ্নে অটল থেকে দেশ পর্যন্ত ছেড়েছেন, তার টেলিগ্রাম অ্যাপে নেই সয়ংক্রিয় এন্ড টু এন্ড ইনক্রিপশন- এটি সিংহভাগ গ্রাহকের কাছে অবিশ্বাস্য।
বর্তমানে টেলিগ্রামের গ্রাহক ৯০০ মিলিয়নের ওপরে। এদের মধ্যে কতজন আলাদা করে সিক্রেট চ্যাট চালু করে টেলিগ্রাম ব্যবহার করে, আদৌ সিক্রেট চ্যাট বলে টেলিগ্রামে কথপোকথন আলাদা করে ইনক্রিপটেড করে নিতে হয় সেটিই বা কতজন জানে- এর সংখ্যা নগণ্য বলে মনে করেন টেক বিশ্লেষকরা।