বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় বিএনপির হাইকমান্ড। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিকল্প কোনো ভাবনা নেই তাদের। দলের এই কঠোর অবস্থানের বিষয়ে সম্প্রতি তৃণমূল নেতাদের বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, একদফা আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ এবং আগামী নির্বাচন নিয়ে কিছুদিন ধরে দলের সাবেক সংসদ সদস্য, বিগত নির্বাচনে ধানের শীষের প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। এ ছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদকসহ দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে। সেখানে বিএনপি যে কোনো অবস্থাতেই শেখ হাসিনার অধীনে আগামী নির্বাচনে যাবে না—দলের এই কঠোর অবস্থানের কথা নেতাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিএনপি কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাবে—সে বিষয়টিও জানানো হয়। নেতাদের বলা হয়, আন্দোলনে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেই আগামীতে ভোটে যাবে বিএনপি। শিগগির চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলন শুরু হবে জানিয়ে তাদের এজন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতিও নিতে বলা হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। সব রাজনৈতিক দল একই কথা বলছে। কারণ তাদের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। অতীতে একাধিকবার সেটা প্রমাণিত হয়েছে। সেই কারণে এ দেশের কোনো মানুষও শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রায় এক বছর ধরে রাস্তায় নেমেছি। এর মধ্যে আমাদের ২২ জন তরুণ নেতার প্রাণ গেছে রাস্তায় পুলিশের গুলিতে। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অসংখ্য নেতা জেলে গেছেন। তার পরও আমাদের দমিয়ে রাখতে পারছে না, পারবে না। চলমান আন্দোলনেই একদফা দাবি আদায় করা হবে।’
এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় খালেদা জিয়াও। গত ১৩ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে নিজের এই কঠোর অবস্থানের কথা জানান তিনি। ওইদিন এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়াকে দেখতে যান তারা।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘খালেদা জিয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যাবে না।’
খালেদা জিয়ার ওই বক্তব্যের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলেন, এখন সরকার একটা নির্বাচনী জাল বিছানোর চেষ্টা করছে। যাতে এই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারে। কিন্তু আমাদের এই নির্বাচনে পা দেওয়া চলবে না।’
বিএনপি চেয়ারপারসনকে উদ্ধৃত করে মান্না বলেন, ‘এটা উনি দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে বলেছেন, কোনো অবস্থায় এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন করা যাবে না।’
এর আগে গত ৮ মে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মাহমুদুর রহমান মান্না। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘খালেদা জিয়া বলেছেন—বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। খালেদা জিয়া সরকারের কোনো ফাঁদে পা না দিয়ে সবাইকে নিয়ে আন্দোলন জোরদার করার কথা বলেছেন।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের পরিপ্রেক্ষিতে চলমান একদফার আন্দোলনকে আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। কারণ দাবি আদায়ে ভিসা নিষেধাজ্ঞাকে এক ধরনের সুযোগ হিসেবে দেখছে দলটি।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এর ফলে সরকার দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাপে পড়েছে। পুলিশসহ প্রশাসনের ওপরও এর প্রভাব পড়েছে। এই চাপ কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান তারা। এর সঙ্গে এখন দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও মুক্তি ইস্যুকেও জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে যাচ্ছে বিএনপি।
জানা যায়, তপশিল ঘোষণার আগেই সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে একটি ফয়সালায় পৌঁছতে চায় বিএনপি। দলটির অনেকে মনে করছেন, তপশিল ঘোষণা হয়ে গেলে তখন নির্বাচন ঠেকানো কঠিন হয়ে যাবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর গত মঙ্গলবার জানান, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ২৪ মে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ঘোষণায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না দেশটি। এর প্রায় চার মাস পর গত ২২ সেপ্টেম্বর ওই ভিসা নীতি কার্যকরের পদক্ষেপ নেওয়া শুরুর কথা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির এমন সিদ্ধান্তের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে নামতে যাচ্ছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো, যা অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হবে। তবে চূড়ান্ত ধাপের এই কর্মসূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির পরবর্তী বৈঠকে এই কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে। গত সোমবার অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিএনপি নেতাদের শঙ্কা, চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারি দলের দিক থেকে বাধা-হামলার ঘটনা আরও বাড়তে পারে। একই সঙ্গে বরাবরের মতো পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলও রাজপথে থাকতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই একদফা আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি ঠিক করতে যাচ্ছে বিএনপি।
অবশ্য বিএনপি ও শরিক দলগুলোর অনেক নেতার দাবি, ২০১৪, ২০১৮ আর ২০২৪ সাল এক নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব আগামীতে বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। এ লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে। অন্য দেশগুলোও সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। সুতরাং বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের নামে ক্ষমতাসীনরা এবার যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে না।
গত ১২ জুলাই থেকে একদফার আন্দোলন শুরু করা বিএনপি বর্তমানে রাজধানী ঢাকা ঘিরে সমাবেশ এবং ঢাকার বাইরে অঞ্চলভিত্তিক রোডমার্চের কর্মসূচি পালন করছে। ১৯ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ১৭ দিনের এ কর্মসূচি আগামী ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোডমার্চের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। এরপর আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
দলটির খসড়া আন্দোলন পরিকল্পনা অনুযায়ী, মধ্য অক্টোবর থেকে আন্দোলনকে সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার চিন্তা রয়েছে বিএনপির। তখন কর্মসূচি হবে লাগাতার এবং রাজধানী ঢাকার ওপর থাকবে আন্দোলনের মূল ফোকাস। ঢাকায় তখন নির্বাচন কমিশন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঘেরাওসহ টানা অবস্থানের কর্মসূচিতে যেতে পারে দলটি। পাশাপাশি রাজপথ, রেলপথ, নৌপথ অবরোধের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে। সঙ্গে আসতে পারে হরতালও। তবে একেবারে বাধ্য না হলে হরতালের মতো কর্মসূচিতে যাবে না দলটি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘আগামীতে আন্দোলনের কী কর্মসূচি আসবে, তা পরিস্থিতিই বলে দেবে। যখন যে কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে, তখন সে কর্মসূচি দেওয়া হবে।’