জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর তৎপরতা এবং রাজপথের আন্দোলনের সমন্বয় ঘটিয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে চায় বিএনপি। সময় যত ঘনিয়ে আসবে, সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক বিশ্বের কূটনৈতিক পদক্ষেপ আরও বাড়বে বলে আশা করছে দলটি। সেই পরিস্থিতিতে আন্দোলন জোরদার করতে পারলে একদফা দাবি আদায় করা সম্ভব হবে বলেও তারা মনে করে। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করার লক্ষ্য বিএনপির। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন জোটের বাইরে থাকা সব মত ও পথের রাজনৈতিক শক্তিকে এক মেরুতে এনে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে বিএনপি থেকে জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রের তথ্য মতে, আগামী নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হবে। তবে দেশের রাজনীতিতে এখনো সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই। একদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন’ আয়োজনে অটল। অন্যদিকে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় বিএনপির হাইকমান্ড। ১৯৯১ সালের পর প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিপরীতমুখী এমন অবস্থানে ছিল প্রধান দুই দল। তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি তৎপর পশ্চিমা দেশগুলো। নির্বাচন ইস্যুতে এরই মধ্যে বাংলাদেশের জন্য আলাদা ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পরে সেই নীতি কার্যকর করা হচ্ছে বলেও জানিয়ে দিয়েছে দেশটি। নিজেদের অবস্থান জানাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কিছু দেশ। পশ্চিমাদের এই কূটনৈতিক চাপ কাজে লাগানোর জন্য রাজপথে সর্বাত্মক আন্দোলনে গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালবেলাকে বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্বসহ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক শক্তি বারবার গণতন্ত্রের প্রতি তাদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তাদের এমন অবস্থান আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে। সেইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, আমরা যারা লড়াই করছি, সংগ্রাম করছি, এটাকে সামনে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। সেটা করতে পারলে চূড়ান্ত বিজয় অবশ্যই আমরা অর্জন করতে সক্ষম হব। সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন কয়েক দিনের মধ্যেই আর পেছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই।’
তিনি বলেন, ‘গুম-খুন করে, মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে আমাদের দমানো যাবে না। নির্যাতন-নিপীড়ন করে ক্ষমতায় বেশিদিন থাকা যায় না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তারা যেটা করতে পেরেছে, এবার ২০২৪ সালে সেই নির্বাচন করতে পারবে না। কারণ, এবার মানুষ যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে করে সেটা সম্ভব হবে না।’
জানা গেছে, গত কয়েক দিনে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতারা বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছেন। গত সপ্তাহে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেতো রেংগলির বারিধারার বাসভবনে মধ্যাহ্নভোজে অংশগ্রহণ করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানের সঙ্গে তার বাসায় বৈঠক করেন ব্রিটিশ হাইকমিশনের রাজনৈতিক কাউন্সিলর টিমোথি ডকেট। এ ছাড়া গত ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ সফরে আসা মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে দেড় ঘণ্টা বৈঠক করেন তারা। সব বৈঠকেই কূটনীতিকদের কাছে নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন দলটির নেতারা। তারা জানিয়েছেন, সরকার পরিবর্তনের জন্য বিএনপি নির্বাচনকে অপরিহার্য মনে করে। কিন্তু সেই নির্বাচন হতে হবে স্বচ্ছ, অবাধ ও নিরপেক্ষ। দলীয় সরকারের অধীনে সে ধরনের নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নেতাকর্মীদের নামে করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার জরুরি বলেও মনে করে দলটি।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, তারা কূটনৈতিকভাবে অনেকটা সফল হয়েছেন। এখন রাজপথের চূড়ান্ত আন্দোলন সফল করতে হবে। এজন্য ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘কিছুদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে খোঁজ নিয়েছেন। তারা ফিরে গিয়ে বলেছেন যে, বাংলাদেশে নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। যুক্তরাষ্ট্রও (প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক টিম) একই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এসেছে। সবার মধ্যেই প্রশ্ন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না? বিএনপির সঙ্গে বৈঠকেও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছেন, নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিক মানের বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশে হবে কি না এবং হতে হলে কী করা দরকার? আমরা সবসময় বলে এসেছি, শেখ হাসিনার অধীনে কোনোভাবে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’
জানা গেছে, আজ (১৮ অক্টোবর) ঢাকায় জনসমাবেশের মধ্য দিয়ে বিএনপির পূর্বঘোষিত ধারাবাহিক কর্মসূচি শেষ হচ্ছে। দুর্গাপূজার পর ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু হতে পারে চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি, যা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলবে। আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, সংসদ ভবন, বিচারাঙ্গন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা এবং ঘেরাও কর্মসূচি থাকতে পারে। ঢাকার পাশাপাশি জেলা ও মহানগর পর্যায়েও একই কর্মসূচি দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে সড়ক ও নৌপথ অবরোধের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান কালবেলাকে বলেন, ‘১৮ অক্টোবর পর্যন্ত আমাদের আন্দোলনের কর্মসূচি রয়েছে। জনদাবি পূরণে পূজার পর এ কর্মসূচি আরও জোরালো হবে। একদফা দাবি আদায়ে গণতান্ত্রিক যত পন্থা রয়েছে, আমরা সেসব পথে শান্তিপূর্ণভাবে এগোবো। সরকার যদি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাধা দেয়, সে দায় তাদেরই নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। গণদাবি মেনে পদত্যাগ করে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম করবে।’
জানা গেছে, সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার আগে যুগপতের শরিকদের মতামত নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে এরই মধ্যে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও লেবার পার্টির সঙ্গে দলটির হাইকমান্ডের বৈঠক হয়েছে। গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরুর পর এটিই ছিল বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে শরিকদের প্রথম বৈঠক।
জানা গেছে, বৈঠকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে সরকারের কোনো প্রলোভনে পা না দিতে শরিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, চলমান আন্দোলনে সরকারের পতনের পর নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিজয়ী হলে শরিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। আন্দোলনে থাকা সব দলকে নিয়ে তখন জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছাতে চান তারা। তবে প্রয়োজনবোধে তপশিলের পরও আন্দোলন চলতে পারে। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চূড়ান্ত আন্দোলন সফল করতে আগামীতে জামায়াতে ইসলামীকেও পাশে চায় বিএনপির হাইকমান্ড। গত ৩০ ডিসেম্বর আন্দোলন শুরুর পর প্রথম দুটি কর্মসূচি যুগপৎভাবে পালন করলেও বিএনপির সঙ্গে টানাপোড়েনে পরবর্তী সময়ে এককভাবে কর্মসূচি পালন করে জামায়াত। সম্প্রতি হাইকমান্ডের নির্দেশে দীর্ঘদিনের এই মিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় বিএনপি। এর অংশ হিসেবে মাস দুয়েক আগে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। গত ১০ অক্টোবর জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেখতে যায়। এর আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দেয় দলটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারবিরোধী চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলন শুরু হলে জামায়াতও সেখানে সম্পৃক্ত হতে পারে। এরই মধ্যে বিএনপির সঙ্গে এ ব্যাপারে তাদের সমঝোতা হয়েছে।
চলমান আন্দোলনকে ফলপ্রসূ করতে দলের সব উইংকে সক্রিয় করছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে এরই মধ্যে ঢাকায় শ্রমিক-কর্মচারী কনভেনশন, ছাত্র কনভেনশন এবং যুব, কৃষক ও মহিলা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া গত ২৯ সেপ্টেম্বর ৯ দফার ভিত্তিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ১৫টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যে’র আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।
বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবি, এবারের আন্দোলনে তারা জীবনবাজি রেখে ভূমিকা রাখছেন। হামলা-মামলা উপেক্ষা করে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় জোরালো আন্দোলন করছেন তারা। বিদেশি চাপের পাশাপাশি আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হবে বলে তাদের আশা।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন কালবেলাকে বলেন, ‘দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও জোট বিএনপির অহিংস আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে রাজপথে নেমেছে। সুতরাং এবার জনগণের ইস্পাতকঠিন আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হবে।’
নেত্রকোনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মো. আনোয়ারুল হক বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। দেশের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এসব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং যেসব নেতাকর্মী কারাবন্দি তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।’