অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগসহ একদফা দাবিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) যুগপৎ আন্দোলন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। সমমনা দল ও জোটগুলোকে নিয়ে ধাপে ধাপে কর্মসূচিতে বৈচিত্র্য আনছে দলটি। এরই মধ্যে পদযাত্রা, সমাবেশ, গণমিছিল, কালো পতাকা মিছিলসহ বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করেছে দলটি। একদফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এবার আগামী সপ্তাহ থেকে লাগাতার কর্মসূচিতে যাচ্ছে বিএনপি। খবর কালবেলা
জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই আন্দোলনের ফসল তুলতে চান সংশ্লিষ্টরা। এজন্য দাবি আদায়ে মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে কঠোর কর্মসূচি চান সবাই। এবার যুগপতের ঘেরাও ও অবস্থান কর্মসূচি থাকবে। দলটির হাইকমান্ড মনে করেন, আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি এমন হতে হবে, যেন সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। এজন্য যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মূল দলের সঙ্গে বিভিন্ন পেশাজীবী ও ছাত্র সংগঠনকেও সক্রিয় করা হচ্ছে। চলমান আন্দোলনের মধ্যেই সামরিক বাহিনীর ২৪ সাবেক কর্মকর্তা গত শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগদান করেছেন।
এবার বিএনপি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আদালতকেন্দ্রিক কর্মসূচিতেও যাবে। এ পর্যায়ে বিভিন্ন রায়ের প্রতিবাদে সমাবেশ, সেমিনার এবং আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় নেতারা বলেন, বর্তমান সরকার আদালতকে ব্যবহার করে বিরোধী দলের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিরোধী নেতাদের সাজা দিতে দ্রুত বিচারকাজ শেষ
করা হচ্ছে। সেজন্য আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান, সংসদ ভবন, গণভবন, নির্বাচন কমিশন ও সচিবালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচির প্রস্তাবনা আসে। পাশাপাশি হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির মতো বিকল্প বিষয়েও আলোচনা হয়। সভায় চলতি মাসের শেষ দিকে ঢাকায় আবারও মহাসমাবেশের মাধ্যমে চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। যুগপতের শরিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে।
সরকার ‘নির্বাচনী সংকট সমাধানে আগ্রহী নয়’—এমনটা মাথায় রেখেই আন্দোলন পরিকল্পনা এখন রাজপথে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। শরিকদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে দাবি মানতে সরকারকে কিছু সময় দেওয়ার পক্ষে মতামত আসে। সরকার এ সময়ের মধ্যে সাড়া দিলে ভালো, অন্যথায় তারা দাবি আদায়ে লাগাতার কর্মসূচিতে যাবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালবেলাকে বলেন, বাইডেন বা যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি। তারা খুব পরিষ্কার করে বলেছে, বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চাই। তারা বলেছে, এখানে সব দলের অংশগ্রহণে একটা ভালো নির্বাচন দেখতে চাই; যেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সমগ্র গণতান্ত্রিক বিশ্ব তাই বলছে। সুতরাং কথা একটাই—সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। চূড়ান্ত কর্মসূচি আসছে। এ ভয়াবহ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে বিজয় অর্জন করতে হবে। এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
ক্ষমতাসীনদের কোনো উসকানিতে পা না দিয়ে একদফা দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ ও অংহিস কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এখনই হরতাল বা জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো কঠোর কর্মসূচিতে তারা যাবে না। মূলত শান্তিপূর্ণ অবস্থানের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান ঘটানোই দলটির লক্ষ্য। এরই অংশ হিসেবে সংগঠনকে শক্তিশালী করাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হচ্ছে। সমমনা ৪২টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন তারা। তাদের দাবি সরকারের পদত্যাগ, খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। অন্যথায় দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, হরতাল দিলে সরকার যদি আমার সাংবিধানিক অধিকারকে সম্মান করে, তবে এক রকম আচরণ করবে, আর বিরোধিতা করলে আরেক ধরনের আচরণ করবে। তখনই সংঘাত অনিবার্য হবে। সুতরাং আমরা সহিংসতা-সংঘাত ও রক্তক্ষয় চাই না। আমরা জীবনক্ষয় চাই না। পরিবেশ ও পরিস্থিতি বলবে আন্দোলনের গতি কী হবে?
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কালবেলাকে বলেন, আমরা ক্রমাগত আঘাতপ্রাপ্ত হলেও পাল্টা আক্রমণে যাচ্ছি না। তবে এটা কতক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব, সেটা বলা মুশকিল। যারা অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার, তারা কিন্তু একত্রিত হয়ে অনেক কিছু করতে পারে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে—এমন কঠোর কর্মসূচির বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এবার বড় ধরনের বিরতি না দিয়ে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার আগ পর্যন্ত কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে চলানোর চিন্তা আছে। আগামী ১৫ থেকে ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কয়েকটি কর্মসূচি আসবে। এরপর ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলনে যাওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। অবস্থান, বিক্ষোভ, ঘেরাও, অবরোধ, এমনকি হরতালও আমরা চিন্তা থেকে বাদ দিচ্ছি না। এ ধরনের কর্মসূচির জন্য চাপ আসছে।
১২ দলীয় জোটের অন্যতম সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, দেশের সব মানুষ এ সরকারের পতন চাই। কারণ, দেশে চলছে গুন্ডাতন্ত্র। এখানে আইনের শাসন ও মানবাধিকার নেই। জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা আন্দোলনের মাধ্যমেই এ সরকারের পতন ঘটাবে। সামনে কঠোর কর্মসূচি আসছে।
এ জোটের আরেক শরিক বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, তপশিলের আগেই চূড়ান্ত আন্দোলনের সফল পরিণতি আসবে বলে আমরা আশা করছি। সরকার বিদেশে যতই দৌড়াদৌড়ি করুক কোনো কাজ হবে না। এবার জনগণ তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
উল্লেখ্য, গত ১২ জুলাই রাজধানীর নয়াপল্টনে সমাবেশ থেকে ১৮ ও ১৯ জুলাই ঢাকাসহ দেশব্যাপী দুই দিনের পদযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকারের পদত্যাগের একদফার আন্দোলনে নামে বিএনপি। এরপর ২২ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে তারুণ্যের সমাবেশ থেকে ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। পরে ওই মহাসমাবেশ থেকে ২৯ জুলাই ঢাকায় পাঁচটি প্রবেশপথে যুগপৎ আন্দোলনের তৃতীয় ধাপের অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেয় বিএনপি। অবশ্য ওই কর্মসূচিতে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছিল।
আন্দোলন জোরালো করতে চায় জামায়াত: এদিকে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রর পুনরুদ্ধার, দলের আমির ডা. শফিকুর রহমানের মুক্তি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠাসহ ১০ দাবিতে রাজপথে আন্দোলন জোরদার করতে চাইছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির একাধিক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা জানান, তারা মাঠে নামার জোরালো প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা মনে করছেন, বর্তমান সরকার ফের ক্ষমতায় এলে দল হিসেবে জামায়াতের অস্তিত্ব আরও সংকটে পড়বে। তৃণমূল নেতাদের নামে থাকা সব রাজনৈতিক মামলার বিচারকাজও শেষ করবে সরকার। এমনিতেই সারা দেশে প্রায় প্রতিদিনই জামায়াতের নেতাকর্মীদের বেছে বেছে আটক করা হচ্ছে। এ ছাড়া পুরোনো বা নতুনভাবে মিথ্যা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। অথচ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী পরিবেশ যেভাবে থাকার কথা, সেটা নেই। এ অবস্থায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর অংশ নেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।
ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ জামায়াতের কয়েকজন নেতা বলেন, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। তবে যা কিছুই হোক, এ সরকারের অধীনে জামায়াত নির্বাচনে যাচ্ছে না। এজন্য আগামীতে নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি অনলাইনে এক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা ও একদফার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতাকর্মীদের সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশের জনগণ সরকারকে আর কোনো নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করতে দেবে না।
মন্তব্য করুন